এই ব্লগটি সন্ধান করুন

শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫


প্রযুক্তির অপব্যবহার

এই যুগ প্রযুক্তির-নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যদি প্রশ্ন করা হয় প্রযুক্তি ছাড়া আমাদের কি একদিনও চলবে খুব জোড়ালো কন্ঠেই উত্তর আসবে না। যেই প্রযুক্তি আমাদের জীবন যাত্রাকে এতটা সহজ করেছে সেই প্রযু্ক্তিগুলোর কিছু কিছু অংশ  আজ আমাদের জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছে। প্রযুক্তির সুফল যেখানে আমাদেরকে বিশ্বদরবারে একটি উন্নত জাতি হিসেবে দাড় করাবে কিন্তু ঘটতে যাচ্ছে তার বিপরীত। আর তার জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই। কথায় আছে কপালের সিদুর যদি পায়ে মোছে  তাহলে কার কি আসে যায়। সত্যিই কথাটার যর্থাথতা রয়েছে, যার প্রমান মিলবে অল্পক্ষনেই।

সেলফোন : একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় সেলফোনের ভুমিকা অপরিসীম। তারওয়ালা ল্যান্ড ফোনগুলোর নানা ঝামেলা এড়াতে আমাদের দেশে প্রচলন হয় তার বিহীন সেলফোনের। প্রথমদিককার সেলফোনগুলোর মাধ্যমে শুধু কথা বলা ও ম্যাসেজ লিখা যেতো। ছিলো না কোনো ক্যামেরার ব্যবস্থা। কিছু দিন যেতে না যেতেই প্রযুক্তিবিদদের অক্লান্ত প্ররিশ্রমে এতে যোগ হলো ক্যামেরা , এমপিথ্রি প্লেয়ার ও এমপি ফোর প্লেয়ার। কিন্তু প্রযুক্তির আর্শীবাদ এই সেলফোনগুলো কতিপয় ব্যবহারকারীর কারনে প্রযুক্তির এক কালো অধ্যায় রচনা করছে। সেলফোন অপারেটরদের নানা সুবিধা ভোগ করতে আজ আমরা রাত ভোর করে দিচ্ছি কথা বলতে বলতে। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের কর্মস্থলে। পাশাপাশি শারিরিক ও মানসিকতো রয়েছেই। স্কুল পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীরাও আজ সেলফোন নেশায় মেতে উঠেছে। তারা বিদ্যালয়ে সেলফোন নিয়ে যাচ্ছে। আর  তাতে লোড থাকছে নানা পর্ণোগ্রাফি যা নিজে দেখছে এমনকি বন্ধুদের নিয়ে ও শেয়ার করছে। যদি বারন করা হয় তাহলে শোনাচ্ছে নানান যুক্তি।

সেলফোন রেডিয়েশনঃ যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষনায় প্রমানিত সেলফোন থেকে যে ধরনের রেডিয়েশন নির্গত হয় তাতে নার্ভ ক্ষতিগ্রস্থ , চোখে ক্যাটরেখ, রক্তের উপাদানগত পরিবর্তন, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি ঘটে থাকে। জাপানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে মুত্যু ঘটেছে এমন লোকের সংখ্যাও সম্প্রতি কম নয়। সম্প্রতি আমাদের দেশের সেলফোন ব্যবহারকারীরাও হাসপাতালের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলছেন। এটি প্রযুক্তির কুফল ছাড়া আর কিছুই নয়।

বিল্ট ইন ক্যামেরা : এবার আসা যাক সেলফোন বিল্ট ইন ক্যামেরার কথায়। সেলফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে নানান রেজ্যুলেশনের ক্যামেরা সংবলিত সেলফোন বাজারে ছাড়ছে। ব্যবহারকারী তার পছন্দনুযায়ী সেলফোনটি ক্যামেরা হিসেবে ব্যববহারের জন্যই উচুঁদরে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তবা সেই ব্যবহারকারী ক্যমেরাটির যর্থার্থ ব্যবহার করছেন। কিন্তু আরেক ব্যবহারকারী ঘটাচ্ছে তার উল্টোটি। আর এসব ঘটনাগুলো যারা ঘটাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই উঠতি যুবক বা যুবতী। যাদের পাড়ার মোড়গুলোতে স্কুল কলেজ ছুটি হবার সময় চুটিয়ে আড্ডা মারতে দেখা যায়। দেখা গেলো(হরহামেশাই ঘটছে) কোনো স্কুল বা কলেজ পড়–য়া ছাত্রী তার সামনে দিয়ে হেটেঁ যাচ্ছে ঠিক তখনি সেই সেলফোনওয়ালা তার একটি ছবি তুলে বসলেন। এতে সেই ছাত্রীটি একটি অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। আবার এর বাধাঁ দিতে গেলেও হয়তো মান ইজ্জত খুইয়ে বসছেন। এমনও হতে পারে সেই যুবকটি সদ্য তোলা এই ছবিটি ইন্টারনেটে নানান বিকৃতি করে ছেড়ে দিচ্ছে এবং সবাইকে জানান দিচ্ছে। কারন দুস্কর্মের জন্য কম্পিউটার জানা পন্ডিতের অভাব হয় না। এভাবে অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হতে  একদিন পত্রিকার পাতায় বড় অক্ষরেই ছাপা হচ্ছে বখাটের উৎপাতে কোনো ফাতেমা বা জুলেখার আত্তাহুতি।

ল্যাপটপ বিল্ট ইন ক্যামেরা : এখনকার ল্যাপটপ কম্পিউটারগুলোতে বিল্ট ইন ক্যামেরা রয়েছে। যা প্রযুক্তির এক নতুন রপরেখা। এই ক্যামেরাগুলো ল্যাপটপ বন্ধ থাকা অবস্থায়ও ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে সক্ষম। ফলে খারাপ লোকের মনবাসনা পুরনে এটি এক সহায়ক ভুমিকা পালন করে।

পেনড্রাইভ : প্রথমে কম্পিউটারের সাথে রিমোভেবল ডিস্ক হিসেবে প্রচলন ছিলো ফ্লপি ডিস্কের। ডেটা লস হবার কারনে এই ডিভাইসটি ততটা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারে নি। ফলে কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। লক্ষ্য একটাই কিভাবে ডেটা অক্ষুন্ন অবস্থায় এক কম্পিউটার থেকে আরেক কম্পিউটারে আদান প্রদান করা যায়। অবশেষে এর সমাধান হিসেবে আবিস্কার হলো পেন ড্রাইভের । আজকাল বাজারে (১২৮, ৫১২ মেগাবাইট, ১,২,৪,৬,৮ গিগাবাইট) পর্যন্তও পেন ড্রাইভ পাওয়া যায়। তাই আজ আমরা খুবই বিশস্ততার সহিত ডেটা আদান প্রদান করছি। কিন্তু এর কিছুটা কুফলও রয়েছে। উদাহরন হিসেবে বলতে হয়, পেনড্রাইভ রয়েছে এমনি একজন তার যে কোনো বন্ধুর কম্পিউটার থেকে নিষিদ্ধ র্ভিডিও চিত্র বা স্থির চিত্র খুব সহজেই পেনড্রাইভে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সাইবার ক্যাফেতে বসেও নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটগুলো ঘেটেঁ তার বিভিন্ন কনটেন্ট পেন ড্রাইভে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে

জ্ঞানের সাধনায় গ্রন্থাগারের গুরুত্ব


বিশ্ববরেণ্য গবেষক ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব আল্লামা ইউসুফ কারজাভির চিন্তা-চেতনা এবং ফিকহ ও অন্যান্য বিষয়ে তার গবেষণা সম্পর্কে আলোকপাত ও মূল্যায়নের লক্ষ্যে চতুর্থ বারের মতো এবারও কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক কনফারেন্স ও সেমিনার। পাঁচ দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠান গত ২ মার্চ রোববার শেষ হয়েছে। এতে পৃথিবীর প্রায় ৫০টি দেশ থেকে আমন্ত্রিত গবেষকরা অংশ নেন এবং আল্লামা কারজাভির গবেষণা ও কর্মের ওপর তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘আল্লামা কারজাভি এবং ফিকহুদ দাওয়াহ।’ বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এ সম্মেলনে অংশ নেন চট্টগ্রামের দারুল মারিফের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য সংস্থার আঞ্চলিক প্রধান আল্লামা সুলতান জওক নদভী এবং ড. জসিমুদ্দীন নদভী। পাক-ভারত উপমহাদেশে আল্লামা কারজাভির প্রভাব ও মূল্যায়ন বিষয়ে সম্মেলনে প্রবন্ধ পাঠ করেন ড. জসিমুদ্দীন নদভী। এর আগে শনিবার অতিথিদের সম্মানে নিজের বাসভবনে কাতারের ঐতিহ্যবাহী নৈশভোজ আয়োজন করেন আয়োজক ইউসুফ কারজাভি। কাতারের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা এতে উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ায় আল্লামা কারজাভি পুরো আরববিশ্বে আলোচিত ব্যক্তিত্ব। ৮৮ বছর বয়সী প্রবীণ এ ব্যক্তিত্ব ইসলামের প্রায় সব বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ১৫০।
সম্মেলনে বক্তারা ইউসুফ কারজাভিকে এ যুগের ইমাম এবং উম্মতের রাহবার হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তিনি যে মধ্যম পন্থা অবলম্বনের জন্য মুসলমানদের বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছেন, সেটাই মূলত ইসলামের প্রধান বৈশিষ্ট্য। শুধু আরববিশ্বে নয়, ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা তার লেখনীর মাধ্যমে বিশেষভাবে উপকৃত হচ্ছেন। অনুষ্ঠানে আগত ছাত্র এবং অতিথিদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন আল্লামা কারজাভি। সেমিনারের বাইরে অতিথিরা কাতারের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করেছেন।
জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই আলো, জ্ঞানই আনে মুক্তি। মানুষের দুই ধরনের ক্ষুধার সৃষ্টি হয়। একটি হলো দৈহিক ক্ষুধা, অন্যটি হলো মানসিক ক্ষুধা। দৈহিক ক্ষুধার চাহিদা যেমন সাময়িক, তেমনি এটা সহজলভ্য। আর মানসিক ক্ষুধার চাহিদা যেমন, তেমনি এটা পূরণ করাও কঠিন। ইসলাম এমনি একটি মানবহিতৈষী ধর্ম, যা এই জ্ঞানরাজ্যের ক্ষুধা নিবারণে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে এবং নানাভাবে এর প্রতি উত্সাহিত করেছে। মুসলমানদের সবচেয়ে প্রিয় গ্রন্থ আল কোরআন শুরুই হয়েছে ‘পড়ো’ নির্দেশ দিয়ে। পবিত্র কোরআনে বারবার এরশাদ হয়েছে, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কখনও সমান নয়।
এই জ্ঞানরাজ্যের ক্ষুধা মেটানোর প্রধানতম অবলম্বন হলো পাঠাগার তৈরি করা। ইতিহাসে যেটাকে মধ্যযুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, সেখানে দেখা যায়, মুসলমানরা বিশ্বময় আলো ছড়ানোর জন্য যেভাবে পাঠাগার, গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন, পৃথিবীর আর কোনো জাতি-গোষ্ঠী তখন তাদের ধারে-কাছেও ছিল না। তারা ছিল অন্ধকার জগতে নিমজ্জিত। বিশেষ করে ইউরোপ তখন তাকিয়ে ছিল মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু কর্ডোভা, গ্রানাডা, বাগদাদ আর মিসরের দিকে। সেখানে তারা বছরের পর বছর পড়ে থেকে জ্ঞানরাজ্যের সন্ধান করেছে। মধ্যযুগের ইতিহাস মুসলমানদের সমৃদ্ধির ইতিহাস, কর্ডোভার ইতিহাস মুসলমান শিক্ষাদীক্ষায় শ্রেষ্ঠত্বের ইতিহাস। পৃথিবীর সব জ্ঞানভাবায়তুল হিকমাহ নামে বিশাল এক গ্রন্থশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়া কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তত্কালীন সেই পাঠাগারে সংরক্ষিত ছিল ছয় লাখ পা ুলিপি। আর এ বইগুলোর নামের তালিকা করতে লেগেছিল ৪৪টি বিশাল গ্রন্থের। পৃথিবীর ইতিহাসে তত্কালীন কর্ডোভা রাজ্যটি বইয়ের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীকালে শাসকদের ভোগবিলাসী জীবন, প্রজাদের আরাম-আয়েশের জীবন মুসলমানদের দ্রুত ধ্বংসের পথ রচনা করে।
আজকের দিনে আমাদের ব্যক্তি এবং পরিবারকে বিকশিত করতে হলে, আলোকময় করতে হলে, পাঠাগার তৈরির কোনো বিকল্প নেই। অবশ্য সেই পাঠাগারে ভালো মানের বই রাখতে হবে। বর্তমান সময়ে কাগজ ও ছাপার কাজ সহজ হওয়ায় ভালো মানের বইয়ের চেয়ে আবর্জনাই বেশি ছাপা হচ্ছে। কোনো পরিবারে যদি পাঠাগার থাকে, তাহলে সেই পরিবারের মানুষের চালচলনে এর একটি প্রভাব লক্ষ করা যায়। আমরা আমাদের গৃহসজ্জার কাজে কত কিছুই তো কিনি; কিন্তু কতজন আছি, আমার আগামী প্রজন্মকে আলোকিত করার জন্য বই কিনে গৃহ সজ্জিত করি? সন্তানের মানসিক বিকাশের জন্য চাই বই। ভালো মানের বই। সন্তানের অবসর সময় কাটানোর জন্য বই হতে পারে তার ভালো বন্ধু। হাতের কাছে বই থাকলে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছাই হোক সে বই পড়বেই। জানার ক্ষুধা সবারই আছে। ছোটদের মধ্যে নতুনকে জানার ইচ্ছা আরও প্রবল।

মুসলিম সমাজে আজ পড়ার প্রচলন কমে যাওয়ায় অফুরন্ত অবসর সময় থাকায় তারা নানা অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে, নানা অপরাধমূলক কর্মকা ের সঙ্গে জড়িত হওয়ার চিন্তা করার সময় পাচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি পরিবারে যদি ছোটখাটো পাঠাগার গড়ে তোলা যেত, তাহলে তাদের এ বিপদের কবল থেকে রক্ষা করা যেত। আজ তরুণ প্রজন্ম নেশাগ্রস্ত। শিক্ষার আলো থেকে তারা বঞ্চিত। ঘরে-বাইরে কোথাও তারা মনের খোরাক পায় না। মনকে বিকশিত করার, মনকে প্রফুল্ল রাখার সন্ধান তারা পায় না। তারা অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখে, তারা সম্পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি দেখে, অন্যের মুখের গ্রাস কীভাবে কেড়ে নিতে হয়, সেটা দেখে। ফলে তাদের মধ্যেও এ মনোবৃত্তি গড়ে ওঠে। আমাদের সমাজকে বিকশিত করতে হলে পাঠাগার বিপ্লব করতে হবে। প্রতিটি পরিবারে একটি করে ছোট পাঠাগার গড়ে তুলতে হবে। বিশেষভাবে নৈতিকভাবে তারা বিকশিত হয়, এমন কিছু বই অবশ্যই পাঠাগারের জন্য সংগ্রহ করতে হবে।
মানুষের জীবনে বই সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। বই মানুষের বিকারগ্রস্ততা দূর করে। বই অবসরের বিনোদন। বই আত্মার খোরাক জোগায়। বই হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে একটি শান্তিময় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উত্সাহিত করে। মানবজীবনে বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। আলো ছাড়া যেমন পথ চলা যায় না, তেমনি বই ছাড়া সত্যিকার কোনো মানুষ হতে পারে না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের গৃহে আজ বইয়ের স্তূপ নেই, বইয়ের কোনো শোকেস নেই, হাঁড়ি-পাতিল আর মূর্তি দিয়ে শোকেস ভরে রাখলেও অতি প্রয়োজনীয় জিনিসটি রাখার জায়গা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। আসুন, আবার বইয়ের কাছে ফিরে যাই, বইয়ের কাছেই আমাদের ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের সব অশান্তি, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা দূরীকরণের চাবিকাঠি। এছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। ভারতের পাটনায় অবস্থিত খোদা বখশ ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি। ১৮৯১ সালে খান বাহাদুর খোদা বখশ এটি প্রতিষ্ঠা করেন। লাইব্রেরিটি দুর্লভ ফারসি ও আরবি পা ুলিপির জন্য বিখ্যাত। এখানে রাজপুত ও মোগল আমলে আঁকা নানা রকমের চিত্র সংরক্ষিত রয়েছে।
শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি সভ্য ও উন্নত হতে পারে না। ভোগ করতে পারে না তাদের স্বাধীনতার সুফল। স্বাধীনতা অর্জনের ৪০ বছর পর এসে বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার বেড়েছে উত্সাহব্যঞ্জকভাবে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও হতাশাব্যঞ্জক নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উত্কর্ষের এ যুগে আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি নানা ঘাত-অভিঘাত সত্ত্বেও। দেশের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে শিক্ষার আলো। প্রত্যন্ত অঞ্চলও খালি নেই প্রাথমিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বা প্রাইমারি স্কুল থেকে। প্রতিটি শহরে গড়ে উঠেছে কলেজ-মহাবিদ্যালয়। দ্রুত বেড়ে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও। সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ ও শিক্ষিত শ্রেণীর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে ধনী-গরিব ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই যাচ্ছে পাঠশালায়। এমনকি শিক্ষার সৌভাগ্যবঞ্চিত গত প্রজন্মের প্রবীণরাও বিদ্যালয়ে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে।
তবে এসব সত্ত্বেও যে সত্যটি অস্বীকার করার মতো নয় তা হলো, আদর্শ চরিত্রবান দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করতে না পারলে আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহ ও ফলপ্রসূ হবে না। সম্ভব হবে না দেশের প্রতিটি নাগরিকের মুখে হাসি ফোটানো। আগে মনে করা হতো, সামাজিক অপরাধের সঙ্গে শুধু অশিক্ষিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীই জড়িত; কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে র্যাব কর্তৃক পরিচালিত মাদক ও নৈতিকতাবিরোধী অভিযান সে ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছে। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা যেসব অসামাজিক ও নৈতিকতাহীন কর্মকা ে জড়িয়ে পড়েছে, তা দেখে দেশবাসী যুগপত্ বিস্মিত ও হতাশ হয়েছে। তখন একযোগে মিডিয়াগুলোতে লেখালেখি হয়েছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতি এবং ধর্মীয় চেতনা হ্রাস পাওয়ার কারণেই এ চারিত্রিক ধস। আজ দেশের এ ক্লান্তিকালে সবাই অনুধাবন করছেন যে, শিক্ষিত ও চরিত্রবান নাগরিক তৈরির কোনো বিকল্প নেই। মানুষকে সুশিক্ষিত ও চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দরকার তাদের মাঝে শিক্ষার আলো এবং পরকালে জবাবদিহিতার ভয় জাগিয়ে দেয়া। এজন্য ইসলাম শুরুতেই মানুষকে শিক্ষিত ও আলোকিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আসমানি প্রত্যাদেশের প্রথম শব্দই ছিল ‘পড়ো’। আর ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-ও দ্ব্যর্থহীনভাবে শিক্ষার গুরুত্ব ঘোষণা করেছেন।
বদর যুদ্ধে শত্রুপক্ষের যারা আটক হয়েছিল, তাদের মধ্যে পণমূল্য না থাকায় যারা মুক্তি পাচ্ছিল না তাদের জন্য তিনি নিরক্ষরকে শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিলাভের সুযোগ দেন। এ থেকে তার শিক্ষার প্রতি অনুরাগ অনুমিত হয়। দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এবং নাগরিকের দুনিয়া ও আখেরাতের এ লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তেও চাই সবার কাছে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেয়া। কিন্তু স্যাটেলাইট চ্যানেলের আধিপত্যের যুগে মানুষ যেখানে ঘরে বসে চটুল বিনোদনের আস্বাদ পাচ্ছে সারাক্ষণ, সেখানে তাদের বই কিনে পড়ার মতো কসরত করার ধৈর্য না থাকাই স্বাভাবিক। এজন্য দরকার জ্ঞানের সুবাস তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া। এ বিবেচনা থেকেই ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার ধারণার জন্ম। যেভাবে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বাড়ছে, সেভাবে বাড়ছে না মানুষকে জ্ঞানের নেশার সন্ধান দেয়ার জন্য এসব মোবাইল লাইব্রেরির সংখ্যা।
চতুর্থ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম মুসলিম প িত ও প্রশাসক সায়েব বিন আব্বাদ আরবজাহানে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রবর্তন করেন। ১৯১২ সালে আমেরিকা অঞ্চলে ঘোড়ার গাড়ির মাধ্যমে পাঠাগার যাতায়াত করত বিভিন্ন লোকালয়ে। আর ফ্রান্সে এটা শুরু হয় ১৯২০ সালে। বর্তমান পৃথিবীতে গাড়িতে করে বহনযোগ্য গ্রন্থাগার প্রায় সব দেশেই চালু আছে। ভেনিজুয়েলার মমবয় বিশ্ববিদ্যালয় দুটি খচ্চরকে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার হিসেবে ব্যবহার করে গ্রামীণ মানুষকে বই সরবরাহ করে থাকে। গ্রামের লোকেরা এটাকে ‘বিবিলোমলাস’ (বইয়ের খচ্চর) বলে অভিহিত করে। বাংলাদেশে প্রথম ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির উদ্যোগ নেয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, এর আলোকিত মানুষখ্যাত অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি নিয়ে তাদের দরজায় কড়া নাড়েন।
পাঠকদের অনেকে হয়তো বলবেন, এ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করবে কে? এটা কার দায়িত্ব, সরকার না জনগণের? আসলে সে প্রশ্ন না করে আমরাই এ কাজ শুরু করতে পারি। দরকার শুধু কয়েকজন উদ্যমী ও কর্মনিষ্ঠ মানুষের। আমরা যারা ইসলাম নিয়ে ভাবি, মানুষের কল্যাণ ও দেশের সমৃদ্ধি চিন্তায় জীবনের নানা ঝামেলা ও কর্মব্যস্ততার মধ্যে খানিক সময় বের করি তাদের উচিত যুগ চাহিদার প্রেক্ষাপটে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা। মন্দ যেখানে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়, ভালোটাকেও সেভাবে সবার হাতের নাগালে পৌঁছে দিতে হবে।
আধুনিককালে তুরস্কের ‘সোলাইমানিয়া’ লাইব্রেরিটির অবস্থান শীর্ষে, ঐতিহ্য, বিশালতা ও সংগ্রহের বৈচিত্র্যে এটি অনন্য। তারপরে মিসরের ‘দারুল কুতুব’ যা প্রাচীন ঐতিহ্য ও ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। ইরাকে আবদুল্লাহ মারাশি নাজাফি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত লাইব্রেরিটি ইসলামী দুনিয়ায় তৃতীয় বৃহত্তম বলে দাবিদার। এ লাইব্রেরিতে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীর ইসলামী সংস্কৃতির দুর্লভ সংগ্রহ রয়েছে। হাতে লেখা প্রাচীন কোরআন শরিফখানাও এ পাঠাগারের হেফাজতে। প্রাচীন হস্তলিপি সংগ্রহের দিক দিয়ে এ পাঠাগারটি শ্রেষ্ঠতম, এক লাখেরও বেশি প্রাচীন হস্তলিপি এখানে জমা আছে। বিজ্ঞানী ইবনে রুশদের ভূগোলসম্পর্কীয় কিতাব ‘আল কানুন’, খাজা নাছির উদ্দিন তুসির চিকিত্সাবিজ্ঞান শাস্ত্র ‘তাহরিরে একলিদেস’ ও শরিফ ইদ্রিসের ‘নাজহাতুল মুস্তাক’ নামের বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মূল পা ুলিপি এখনও বিদ্যমান আছে। গ্রন্থসংগ্রহ ও জ্ঞানচর্চার সুবিধার্থে পবিত্র নগরী মদিনায় স্থাপন করা হয়েছে ‘মাকতাব আল আবদুল আজিজ’। এটি মসজিদে নববির বারান্দার পশ্চিম অংশে অবস্থিত। ইসলামী সভ্যতা ও জ্ঞানচর্চার স্বর্ণালি যুগের মিউজিয়ামও বটে। এ পাঠাগারের সংগ্রহ ইসলামী জ্ঞানভা ারের এক বিশাল অমূল্য সম্পদ। সারা দুনিয়ার দুর্লভ ইসলামী প্রকাশনার পা ুলিপিসহ অসংখ্য বৈচিত্রে ভরা পবিত্র কোরআন, হাদিস ও ধর্মীয় কিতাবের বিশাল সংগ্রহ সংরক্ষিত আছে। শুধু কোরআনে কারিমের পা ুলিপি রয়েছে প্রায় এক হাজার ৮৭৮টি। এর সঙ্গে রয়েছে ৮৪টি হস্তলিখিত কোরআনের বিশেষ অংশ। দুর্লভ অমূল্য কিতাবই আছে প্রায় ২৫ হাজার। ৪৮৮ হিজরিতে আলী বিন মুহাম্মদ আল বাতলিওসি কর্তৃক হরিণের চামড়ার ওপরে লিখিত পবিত্র কোরআনসহ ১৫৮ কেজি ওজনের বৃহদাকার হস্তলিখিত পবিত্র কোরআনের কপিটি এ লাইব্রেরির অহঙ্কার, যা গোলাম মুহিউদ্দিন কর্তৃক লিখিত। ‘মাকতাবাত আবদুল আজিজ’ পাঠাগারটি তথ্যগ্রন্থ, পা ুলিপি, অভিসন্দর্ভ, গবেষণাপত্র ও অত্যাধুনিক সুবিধাদির জন্য বিশ্ববিখ্যাত। ১৯৭৫ সালে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ চত্বরে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মীয়, ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা, মুসলিম ঐতিহ্য, মুসলিম মনীষীদের জীবনীমূলক বই প্রণয়ন ও প্রকাশ করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার মতো মহত্ কাজ করছে এ প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থসহ অন্যান্য বইয়ের সংখ্যা এক লাখ ১০ হাজারেরও বেশি। হজরত ওসমান (রা.)-এর হাতে লেখা ও পবিত্র কোরআনের ছায়ালিপি, ৬১ কেজি ওজনের ১১০০ পৃষ্ঠা পৃথিবীর অন্যতম সর্ববৃহত্ হাতে লেখা কোরআন ও ২.৩৮ গ্রাম ওজনের ক্ষুদ্র এক কপি মুদ্রিত কোরআনের সংগ্রহ ইসলামিক ফাউন্ডেশন লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করেছে।

বই পড়ার মধ্য দিয়ে মানুষ তার চিন্তার জগত্ প্রসারিত করে। বিবিধ সত্ গুণাবলি আয়ত্ত করার কৌশল শিখে নেয়। একজন সত্ মানুষ আরও সত্ হয়, তার সচেতনতা বাড়ে, দায়িত্বশীল ও জ্ঞানী মানুষ হিসেবে সে গড়ে ওঠে। বই এবং পাঠের অবদানে এভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের জন্য অপরিসীম কল্যাণ বয়ে আনে। মানুষের পাঠাভ্যাস এবং তার প্রসারণ মূলত মানুষের বিশেষ ইচ্ছাশক্তি এবং সুবিধাবোধের আকাঙ্ক্ষার মাপকাঠিতে বিচার্য। তবে পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি তথা পাঠস্পৃহা জিইয়ে রাখা খুবই কষ্টকর। এজন্য গ্রন্থবিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন, গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই পাঠাভ্যাস সৃষ্টি ও পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি করা যেতে পারে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের গ্রন্থাগারকে মনে করা হতো শুধু জ্ঞানের ভাধ্যান-ধারণা পাল্টে ‘গ্রন্থাগার’কে (পাঠাগার) বিজ্ঞানের মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর এ দেশে সর্বপ্রথম প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান নামে একটি বিভাগ খোলা হয়েছে।
মানুষের হাজার হাজার বছরের লিখিত-অলিখিত সব ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে একেকটি গ্রন্থাগারের ছোট ছোট তাকে। গ্রন্থাগার মূলত মৃতের সঙ্গে জীবিতদের যোগাযোগের প্রথম বাহন। শিলালিপি থেকে শুরু করে প্রাচীন ও আধুনিক লিপির গ্রন্থিক স্থান এ গ্রন্থাগার। একটি পাঠাগার মানবজীবনকে পাল্টে দেয়। পৃথিবীর মহান মনীষীরা শৈশব-কৈশোরেই কোনো না কোনোভাবে গ্রন্থাগারের সংস্পর্শে এসেছেন। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ধর্মীয় নীতিজ্ঞান, চিকিত্সাবিদ্যা ও প্রযুক্তি—সব ধরনের জ্ঞানের উত্স হতে পারে নগর বা মফস্বলের সাধারণ মানের একটি পাঠাগার। বই কিংবা পাঠাগার আত্মার খোরাক জোগায়। সাহিত্যিক প্রতিভা বসু যথার্থই বলেছেন ‘শ্রেষ্ঠ আত্মীয় যার সঙ্গে কখনও ঝগড়া হয় না।’
বাংলাদেশে পাঠাগার : জ্ঞান অর্জনের জন্য মানুষের উত্তম পদ্ধতি হলো পড়াশোনা করা। জ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে পাঠাগারের ভূমিকা অনেক বেশি বলেই যুগে যুগে পাঠাগার গড়ে উঠেছে। গ্রন্থাগার (খরনত্ধত্ু) বা প্রকৃত অর্থে পাঠাগার হলো বই, পুস্তিকা, ধর্মগ্রন্থসহ অন্যান্য পঠন ও তথ্যসামগ্রীর সংগ্রহশালা, যেখানে পাঠকের প্রবেশাধিকার থাকে এবং পাঠক সেখানে পাঠ, গবেষণা কিংবা তথ্যানুসন্ধান করতে পারেন। সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত গ্রন্থাগারকে ‘গণগ্রন্থাগার’ (চঁনষরপ খরনত্ধত্ু) বলে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব লাইব্রেরি গড়া হয় ছাত্র-শিক্ষকদের অধ্যয়ন ও গবেষণার লক্ষ্যে। রাষ্ট্রীয় পাঠাগার হিসেবে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ছাড়াও রয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক গ্রন্থাগার ব্যান্সডক লাইব্রেরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি বিদ্যমান আছে, যা আধুনিক ও সমৃদ্ধ। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায়ও পাঠাগার রয়েছে। প্রান্তিক এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক ছোট-বড় পাঠাগার চালু আছে। বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নিজস্ব পাঠাগার আছে, যাতে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অধ্যয়নের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হতে পারে।
পৃথিবীতে লাখো কোটি পাঠাগার বা লাইব্রেরি জ্ঞানের সব শাখা-প্রশাখা ছড়াতে প্রস্তুত থাকলেও এর গ্রহীতা হিসেবে পাঠকদের অংশগ্রহণের হারে অঞ্চলভেদে তারতম্য রয়েছে। বাংলাদেশে পাঠাগারে বই পড়ার মতো একনিষ্ঠ পাঠকের সংখ্যা নেহায়েত কম। আর বইপ্রেমী নারী পাঠকের বড়ই আকাল। অধিকাংশ বাড়ির শোকেস শৌখিন সামগ্রীতে ভরা থাকে, বই বাদে। অথচ সবারই জানা কথা, বই ভর্তি শোকেসের মতো দৃষ্টিনন্দন আর কিছুই হয় না। দুর্মুখেরা বলে থাকে, নারীরা পঠন বইয়ের চেয়ে নাকি চেক বই হাতে নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে!
পাঠাগার মুসলিম ঐতিহ্যের অংশ : মূলত ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার কারণেই মুসলমানরা জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র হিসেবে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে আসছে। পবিত্র কোরআন মজিদে অন্তত ৯২ জায়গায় জ্ঞানচর্চা-গবেষণার প্রসঙ্গ এসেছে। ‘আল কোরআন’ শব্দটির একটি অর্থ ‘অধ্যয়ন’। আল কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ আয়াত ‘ইক্রা বিইস্মি রাব্বিকাল্লাজি খালাক,’ অর্থাত্— পড়ো! তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। মহানবী (সা.)-এর বিখ্যাত সহি হাদিস ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ।’ সৃষ্টিতত্ত্ব বুঝতে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে চিনতে হলে, জ্ঞানচর্চার জন্য অধিক পারিমাণে পাঠাভ্যাস করতে হবে। পাঠাগারে নিজেকে লীন করে প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার শিক্ষা গ্রহণ করে আত্মশুদ্ধি লাভ করতে হবে।
মধ্যযুগে যখন গোটা ইউরোপ অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবেছিল তখন মধ্যপ্রাচ্য, স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, গ্রানাডা ও কর্ডোভাসহ মুসলিম দুনিয়ার প্রায় সর্বত্র পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটে। মুসলমানদের মধ্যে পাঠাগারের আদি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যিনি সবার কাছে সমাদৃত, তিনি হলেন প্রিন্স খালিদ। তিনি গ্রিক বিজ্ঞান, রসায়ন আর চিকিত্সা বিজ্ঞান অধ্যয়নের ব্যাপারে উত্সাহী হয়ে গ্রিক ভাষার বই-কিতাবগুলো অনুবাদ করে নিজ গ্রন্থাগারের সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। অষ্টম শতাব্দীতে বাগদাদের উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফারা ‘দারুল হিকমা’ নামের লাইব্রেরি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্লেটো, এরিস্টটলের মতো বিখ্যাত মনীষীর গ্রিক ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলো আরবি ও লাতিন ভাষায় অনুবাদ করে মুসলমানরা ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান সমৃদ্ধ করেছে। সমকালীন মিসরের কায়রোতে ‘বায়তুল হিকমা’ও অনুরূপ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীন ভারতবর্ষে ইসলাম আগমনের আগে প্রচলিত শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনেরও সংরক্ষণ করেছে মুসলমানরা পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।


গল্প হলেও সত্য

                                তথ্যযুক্তি কি অভিশাপ!

রাশেদ (ছদ্মনাম), একটি স্বনামধন্য স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।  প্রতিদিন বিকালে সে স্কুল থেকে ফিরে একটু 
বিশ্রাম নিয়ে পড়তে বসে। ১১টা বাজলে পরিবারের সাথে রাতের খাবার শেষে করে।  পরিবারের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন রাশেদ তার কম্পিউটারের সামনে বসে।

 কৈশর বয়সে প্রযুক্তির নতুনত্বের স্বাদ পেতে মধ্য রাত পর্যন্ত চলে বিভিন্ন ওয়েব সাইটে তার ঘুরে বেড়ানো। ফ্রেইন্ডশিপ ওয়েব সাইটে রেজিস্ট্রেশন ও মেইল আদান প্রদান, থ্রেড পড়া এবং ওয়েব ক্যামে অবাধ চ্যাট- এভাবেই প্রতি রাতে তার ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় পার হয়।

 তার ব্যক্তিগত কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কের বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত নানা ভিডিও চিত্র। মাল্টিমিডিয়া সুবিধাসমৃদ্ধ মোবাইল ফোন ও পেনড্রাইভের মাধ্যমে এসকল ভিডিও চিত্র মাঝে মধ্যে সে তার সহপাঠীদের দিয়ে থাকে। তার সহপাঠীরাও রাতের বড় একটি সময় ব্যয় করে কম্পিউটারের সামনে।

অবাধ তথ্য প্রযুক্তির যুগে কিশোর, তরুণ ও যুব সমাজের বড় একটি অংশ আশঙ্কাজনকভাবে জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের সাইবার ক্রাইমে।

 সাইবার ক্রাইম থেকে পরবর্তীতে ঘটছে নানা ধরনের বড় বড় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, নতুনত্বের প্রতি তরুণ সমাজের আসক্তি, সামাজিকভাবে সচেতনতার অভাব, পরিবারের উদাসীনতা, ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে জীবন যাপন, সুফল কুফল বিচার বিবেচনা না করেই প্রযুক্তির ব্যবহার, সঙ্গ দোষ, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবই মূলত সাইবার ক্রাইম সংঘটনের মূল কারণ। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের গাফিলতিও এ জন্য অনেকাংশে দায়ী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য সাইবার ক্যাফে। এ সকল ক্যাফেতে মূলত উঠতি বয়সীরাই বেশি ভিড় করে থাকে। স্কুল কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা এ সকল ক্যাফেতে সময় কাটায়। ফেসবুক, স্কাইপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নামে বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে।

 এ ধরনের কয়েকটি সাইবার ক্যাফেতে কথা বলে জানা গেছে, মূলত এখানে যারা আসে তারা ইন্টারনেটে চ্যাট বা কনভারসেশন করে বেশি সময় পার করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন অশ্লীল ওয়েব সাইটে তারা প্রবেশ করে ভিডিওচিত্র সিডিতে বা পেনড্রাইভে ডাউনলোড করে নিয়ে যায়। পরে তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়।

 সরকারের টেলি কমিউনিকেশন রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ কিছুদিন আগে শতাধিক ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিলেও এখনো কয়েক হাজার অশ্লীল ও অরুচিকর ওয়েব সাইট বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এসকল ওয়েব সাইটে ১৮ বছরের কম বয়সীদের প্রবেশে নামমাত্র একটি সতর্কতা নোটিশ দেয়া থাকে। যা বাস্তবিক অর্থে কেউই মানে না। এ সকল ওয়েব সাইট শুধু মাত্র নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করা ছাড়া আর কোনো কাজে আসে না।

ইদানীং মোবাইল ও কম্পিউটারের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির মারাত্মক বিস্তার ঘটেছে। বিভিন্ন সিডি’র দোকান ও সাইবার ক্যাফের মাধ্যমে দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ছে। এ কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে মোবাইল ফোন।

 বর্তমানে দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট আইন বা নির্দেশনা নেই। কম দামী হওয়ায় মাল্টিমিডিয়া সুবিধা সম্বলিত হ্যান্ডসেট তরুণদের হাতে হাতে ঘুরে ফিরছে। ইন্টারনাল বা এক্সটারনাল মেমরীর মাধ্যমে মোবাইল ফোনে অশ্লীল ভিডিও চিত্রগুলো সংরক্ষণ ও ব্লু টুথ প্রযুক্তিতে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অন্যের মোবাইল ফোনে।

 এক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণী ও গৃহবধূরা।

সব কিছুরই ভালো-মন্দ উভয় দিক রয়েছে। প্রযুক্তির এ দু’টি দিক সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের আগেই প্রযুক্তি আমাদের হাতে চলে আসে। তরুণ প্রজন্ম স্বাভাবিকভাইে নতুনত্বকে গ্রহণ করে। কুফল সম্পর্কে তারা সচেতন নয়।



তাই আইনের প্রয়োগের চেয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা বেশী জরুরী। পরিবারের অসচেতনতাও যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির বিভিন্ন স্তর রয়েছে।

 সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবে। প্রযুক্তিকে ভালো কাজে ব্যবহার করতে হবে। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সুষ্ঠু বিনোদনের অভাব থেকেই মূলত ধ্বংসের পথে পা বাড়াচ্ছে।

 নৈতিক অধঃপতন থেকে তাদের ফেরাতে প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় লাইব্রেরী ও খেলাধুলার ক্লাব স্থাপন করতে হবে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবারকে সন্তানের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধ করতে সরকারেরও সমান দায়িত্ব রয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৫

পরিচিতি

    ছানাউল্লাহ শামসের  ভার্চুয়াল জগতে স্বাগতম 


ক্যাপশন যুক্ত করুন